তাহিরপুরে পিআইসি গঠনে অনিয়মের অভিযোগ, ক্ষুব্ধ কৃষকরা

কৃষক নয় এমন ব্যক্তিদের দিয়ে কমিটি গঠন এবং বাঁধের কাজ শুরুতে বিলম্ব হওয়ায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

স্টাফ রিপোর্টার::

২০১৭ সালের প্রলয়ংকরী আগাম বন্যায় সুনামগঞ্জের বোরো ধানের সম্পূর্ণ ফলন নষ্ট হওয়ার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশোধন হয় ‘কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা’। সংশোধিত নীতিমালায় বাঁধের কাজ শুরু ও শেষের সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বিলম্ব হচ্ছে প্রতি বছরই। আর বিলম্বের অজুহাত হিসেবে থাকে হাওরের পানি ধীরে নামার বিষয়। সেই ধারাবাহিকতা এবারও বজায় রয়েছে। তবে এ বছর হাওরে পানি ধীরে নামার অজুহাতের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের ঘাড়েও বর্তেছে বিলম্বের দায়।

এসব অনিয়ম আর গাফিলতির কারনে ২০১৭ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বোরো ধানের আবাদ। এবারও সময় মতো পিআইসি কমিটি গঠন না করায় ও কৃষক নয় এমন ব্যক্তিদের দিয়ে কমিটি গঠন এবং বাঁধের কাজ শুরুতে বিলম্ব হওয়ায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

এদিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় ৮৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) অনুমোদন দেওয়ার পরে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী’র বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও কৃষক নয় এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের ইচ্ছে মতো কমিটি গঠন করার। তবে, কমিটি গঠনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী প্রকৌশলী’র সাথে ইউএনও সমন্বয় করেন নি বলে জানিয়েছেন ঐ প্রকৌশলী।

এছাড়াও গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তাহিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি কর্তৃক হাওরে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার সময় বাঁধা ও হামলা চেষ্টা করে একটি পক্ষ। পরে এ ঘটনায় তাহিরপুর থানায় একটি মামলা হয়। তবে এই মামলার আসামি ও সাময়িক বরখাস্তকৃত ইউপি সদস্য এমদাদুল হককে সভাপতি করে মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পে একটি (৫৬নং) পিআইসি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কাজে বাঁধা দেওয়া মামলার আসামিকে কমিটির সভাপতি করায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন তাহিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি। তিনি বলেন বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন ইউএনও’র সাথে।

অন্যদিকে, মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পে (৫৮ নং পিআইসি কমিটিতে) সভাপতি করা হয়েছে তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর (দঃ) ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবুল মিয়াকে। যিনি রাজনীতির পাশাপাশি জড়িত আছেন মৎস ব্যবসার সাথে। এদিকে অনুমোদন হওয়া ৮নং ও ১১ নং প্রকল্পে সদস্য সচিব করা হয়েছে সহোদর দুই ভাইকে। তারা হলেন পাঠাবুকা গ্রামের জিয়া উদ্দিন চৌধুরী’র পুত্র মো. সুজাত হোসেন চৌধুরী ও এনায়েত হোসেন চৌধুরী। 

এছাড়াও একই গ্রামের জুনায়েদ মিয়া একাই দুইটি পিআইসি হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তার চাচাত ভাই এর স্ত্রী’র নামে নিয়েছেন আরেকটি পিআইসি কমিটি। জুনায়েদ মিয়া ৫ নম্বর পিআইসি কমিটির সভাপতি আর তার ছোট ভাই  মুবাশ্বির ৬ নম্বর পিআইসি কমিটির সদস্য সচিব, অপরদিকে তার চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী নাজমা ৪ নম্বর পি আইসি কমিটির সদস্য সচিব। তারা নামকাওয়াস্তে পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব হলেও তাদের নাম ব্যবহার করে মূলত কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে মধ্যস্বত্বভোগী।

অভিযোগ আছে, হাওরের প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাঁধের কাজ। ফলে কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শুধু মহালিয়া হাওর নয় উপজেলার শনি ও মাতিয়ান হাওরেও বেশ কয়েকটি পিআইসি কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকের হাতে। এমনকি কৃষক নন এমন একই পরিবারের ২-৩ ভাই পিআইসির সভাপতি কিংবা সদস্য সচিব বনেছেন। তবে অযোগ্যদের পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব এর দায়িত্ব দেওয়ায় ফুঁসে উঠছেন হাওরের কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, অনুমোদন হওয়া কমিটি বাতিল করে পূনরায় নতুন করে প্রকৃত কৃষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করার কথা।

পাঠাবুকা গ্রামের বাসিন্দা ও দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া বলেন, ‘যাদের কাজ করার সামর্থ ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই তাদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিয়নে আমার ওয়ার্ডেই পিআইসি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কাজ দেওয়া হয়েছে অনেক অযোগ্যকে। যাদের যোগ্যতা আছে তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মাঠিয়ান হাওরের পারের কৃষক ও পরিবেশ কর্মী আব্দুল আমিন বলেন, প্রতি বছর নিতিমালা অনুযায়ী গনশুনানীর মাধ্যমে  পিআইসি কমিটি গঠন করা হয়। এই বছর গনশুনানী করার পর এসও এক দালালের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষককে বাদ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের সুপারিশে কয়েকটা কমিটি দিয়ে বাকি প্রায় সব কটি কমিটি প্রতিটি এক লক্ষ করে টাকার বিনিময়ে দিয়েছে, যাহা নিতীমালা বহির্ভূত। আমরা প্রকৃত কৃষক যারা আছি তারা এই অনিয়মের  তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাই। প্রতি বছর যারা সফলতার সাথে পি আই সি কমিটির কাজ করে তাদেরকেও বাতিল করা হয়েছে। আমরা হাওরবাসী এই অনিয়মতান্ত্রীক প্রকাশিত কমিটি বাতিলের দাবি জানাই। 

হাওর বাঁচাও তাহিরপুর উপজেলা যুগ্ম আহ্বায়ক তুজাম্মেল হক নাছরুম    বলেন, ‘যদি কোনো পিআইসি নিয়ে বিতর্ক কিংবা অভিযোগ ওঠে, তাহলে এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে আমি মনে করি। প্রকৃত কৃষকরা যদি বাদের কাজ পায় তাহলে হাওরের ভালো কাজ হবে।

এবিষয়ে তাহিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা পারভীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি পিআইসি কমিটি গঠনের অনিয়মের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন। উল্টো তিনি বলেন, কমিটি গঠন করা হয়েছে, এখন কারও মৌখিক কোনো অভিযোগ গ্রহণের সুযোগ নেই, নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছি। কারোও কোনো অভিযোগ থাকলে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্য তিনি বলেন। 

তাহিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির  উপদেষ্টা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, আপাতত নির্বাচন নিয়ে জামেলায় আছি, পিআইসির বিষয়ে কিছু জানি না। তবে এসব কমিটি ইউএনও কারো সাথে সমন্বয় ছাড়াই গঠন করেছেন।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের বন্যার পর সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের জন্য পাঁচ থেকে সাত সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কাজের আর্থিক মূল্যের হিসাবে প্রতি ২৫ লাখ টাকার একটি করে স্কিম প্রস্তুত করে তার জন্য বাঁধের পার্শ্ববর্তী কৃষি জমির মালিকদের নিয়ে একটি করে পিআইসি গঠন করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের আগে জরিপ শেষ করে সব পিআইসি গঠন করতে হবে। তারপর ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ## 

নিউজটি শেয়ার করুনঃ