হিমাদ্রি শেখর ভদ্র ::
বিশ^ম্ভরপুরের মুজিব পল্লীতে মাথা গুজার ঠাঁই পেয়েছেন জীবন সংগ্রামী নারী নাসিমা খাতুন। আগে বাবার বাড়িতে লাঞ্চনাগঞ্জনা সহ্য করে বসবাস করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া এক খন্ড জমি ও ঘরের মালিক তিনি। দর্জির কাজ করে ছেলে মেয়েকে পড়াচ্ছেন। আশির দশকের কথা চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার পদ্মা তীরের বিষকাঠালী গ্রামের হাবিবুর রহমান ও পিয়ারা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে নাসিমা খাতুন বড়। বাবা ছিলেন দিনমজুর আর মা গৃহিনী। অভাব অনটনের সংসারের সুখ আলো জ¦ালাতে মায়ের ইচ্ছে ও প্রথম স্বামীর প্রলোভনে হাইমচর থানার গন্ডামারা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করার সময় ১৯৯৭ সালে সন্তোষপুর গ্রামের যুবক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার প্রথম বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর তিনি স্কুলে পড়ালেখা করে অষ্টম শ্রেনি পাস করেন। পরে স্বামী আনোয়ার হোসেন সৌদি আরব যাওয়ার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে নগদ দুই লাখ টাকা নেয়। সৌদি আরব যাওয়ার পরে নাসিমার পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় প্রথম স্বামী আনোয়ার হোসেন। ইতিমধ্যে পদ্মার আগ্রাসী ভাঙ্গনে নাসিমাদের ঘরবাড়ি সহায় সম্বল নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ২০০৬ সালে হাবিবুর রহমান স্বপরিবারে চলে আসেন বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে। সেখানে থিতু হন তিনি। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম স্বামীর ঘর করেন। এক পর্যায়ে ছোট্ট নাসিমাকে গার্মেন্টে চাকরির জন্য একা নিয়ে যান। সেখানে নাসিমা তার এক আত্মীয়র মাধ্যমে হাতিরপুল মগবাজার এলাকায় গার্মেন্টেসে মাসিক ১ হাজার ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি করেন। শুরু জীবনের এক নুতন অধ্যায় । গার্মেন্টেসের আলো আধারিতে কাটতে থাকে নিঃসঙ্গ নিরাভরন জীবন। গার্মেন্টে কাজ করার সময় ২০০৫ সালে তিনি ফরিদপুর জেলার ইয়াদ আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচার নির্যাতনের কারণে ২০১৩ সালে মাত্র ৫ বৎসর সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ের দা¤পত্য জীবনের ইতিঘটে।বিয়ের আগে নাসিমা জানতেন না তার দ্বিতীয় স্বামী মদ জুয়ায় আসক্ত। তখন গার্মেন্টেসের বেতন স্বামীর মদ জুয়ার খরচ যোগাতে শেষ হয়ে যেতো। মাস মাস দোকান থেকে বাকিতে মালপত্র কিনে সংসার চালাতেন তিনি। এক পর্যায়ে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় সুরমা আক্তার মুন্নী ও সোহরাহ হোসেন মিঠু নামের দুই সন্তানের। স্বামী ইয়াদ আলীর নিয়মিত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি আবারও একা বাসা ভাড়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জের
একটি গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করেন। পরে জানতে পারেন স্বামী ইয়াদ আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। নারায়ণগঞ্জ তারাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো মুন্নি। ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় তিনি অনেক কষ্ট করে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যান। সকাল ৮ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে বাসায় এসে দেখেন ছেলে মেয়ে দুজন রান্নার চুলার পাশে একাএকা ঘুমিয়ে থাকে। তখন বাসার দরজা জানালা খোলা থাকে তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৬ বছর বয়সের মুন্নী ও আড়াই বৎসরের ছেলে মিঠুকে বাবার বাড়ি জগন্নাথপুরে পাঠিয়ে দেন। বাবার বাড়িতেও দুই সন্তান নানান অত্যাচার নির্যাতন অবহেলা স্বীকার হন। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তিনি চলে আসেন বিশ^ম্ভরপুরে। সেখানে তিনি একটি ঘর ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী মুন্নীকে নিয়ে বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার দূর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ভালো লেখাপড়ার স্বার্থে মেধাবী ছাত্রী মুন্নীকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবুজ কুড়িতে ভর্তি করে দেন। সেখানে মুন্নী পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। পরে সে কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ২০২৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবে সে। ধনপুর মুজিব পল্লী থেকে প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে সে স্কুলে আসা যাওয়া করে। সুরমা আক্তার মুন্নী জানায়, প্রতিদিন ভোর ৫ টায় সে ঘুম থেকে ওঠে ৭ টা পর্যন্ত লেখাপড়া করে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আবার বিকেলে তিনঘন্টা সেলাইয়ের কাজ করে আবার পড়তে বসে। সে পেশাদার দর্জির মতো সেলোয়ার কামিজ,ম্যাক্সি,পেটিকোট ব্লাউজ কাটতে ও সেলাই করতে পারে। এভাবে সেলাই কাজ করে মাকে সহযোগিতা করে। ভাই সোহরাব হোসেন মিঠু কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সে জানায় মা ও বোনের দর্জি কাজের আয়-রোজগারের তাদের সংসার চলে। স্কুলের শিক্ষকরা তাদেরকে বইপত্র খাতাকলম দিয়ে সহযোগিতা করেন। কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনজির আহমদ মানিক জানান, স্কুল ছাত্রীর পড়াশোনা জন্য স্কুলের পক্ষ থেকে শিক্ষকরা সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সহায়তা করা হবে। স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য বাইসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছে। কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাসনাত কবীর স্বপন জানান, চার বছর যাবত মুন্নীকে বিনা খরচে আমি প্রাইভেট পড়িয়ে যাচ্ছি। স্কুলের বেতন মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। মেয়েটি আদম্য সাহস আর ইচ্ছে শক্তি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।