টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে বিস্ফোরণ ১৮ বছরক্ষতিপূরণের আশায় জীবন কাটছে আশপাশের মানুষ

দোয়ারাবাজার প্রতিনিধিঃ
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের টেংরাটিলা বিস্ফোরণের ১৮ বছর পূর্ণ হলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি এলাকার পরিবেশ। নিত্য নৈমিত্যিক নানা দুর্ভোগ সঙ্গী করেই জীবন কাটছে আশপাশের মানুষের। কয়েক বছর আগেও স্থানীয়রা নিজস্ব প্রযুক্তিতে ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস উত্তোলন করে ব্যবহার করছে। তবে এখন আর আগের মতো বিভিন্ন স্থান দিয়ে গ্যাস উঠছে না। এলাকার মাটি, পানি ভয়াবহ বিস্ফোরণের চিহ্ন বহন করে চলেছে। আশপাশের কয়েক গ্রামে নানা রোগ বালাই লেগেই আছে। মাটির গভীরে যায় এমন কোন গাছ এখানে বাঁচে না। গ্রামবাসীকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় আধা কিলোমিটার দূর থেকে। এদিকে কানাডিয়ান কো¤পানী নাইকোর সঙ্গে সরকারের মামলায় থাকায় গ্যাস উত্তোলনে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী পায়নি ক্ষতিপূরণও। পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে গ্যাসফিল্ড। এ অবস্থায় হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন গ্যাসফিল্ড এলাকার মানুষজন। সরেজমিনে দেখা যায়, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে খনন কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ পাইপ পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চারপাশের নিরাপত্তা বেস্টনীও জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে কয়েকজন আনসার সদস্য থাকলেও গেটে তালা দিয়ে তারা ভেতরে অবস্থান করছিলেন। গ্যাসফিল্ডের চারিদিকের থাকা জলাশয়, খাল, বিল, টিউবয়েল, বসতঘর, উঠোন, পুকুর, কৃষিজমি, দিয়ে আগের মতো এখন আর বুদবুদ করে গ্যাস উঠছে না। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডে প্রথম দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আগুনের তাপে ওই দিন রাতেই গ্যাস ফিল্ডের প্রডাকশন কূপের রিগ ভেঙে আগুন ২০০ থেকে ৩০০ ফুট ওঠানামা করছিল। পরে এক মাসেরও বেশি সময় জ্বলার পর আপনা আপনি নিভে আগুন। দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণ ঘটেছিল একই বছরের ২৪ জুন রাত ২টায়। মধ্যরাতে নাইকোর তরফ থেকে প্রথমে বিপদসংকেত বাজানো হয়। পরে রাত ৩টায় নাইকোর পক্ষ থেকে লোকজনকে এলাকা ছেড়ে তিন কিলোমিটার দূরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। রাত সাড়ে ৩টায় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। কূপ এলাকার তিন কিলোমিটার দূরেও ভূক¤পন অনুভূত হয়েছিল। দু’দফা অগ্নিকান্ডে গ্যাস ফিল্ডের তিন বিসিক গ্যাস পুড়ে যায় এবং ৫.৮৯ থেকে কমপক্ষে ৫২ বিসিক গ্যাসের রিজার্ভ ধ্বংস হওয়াসহ আশপাশের টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরিশনগর, কৈয়াজুরি, টেংরাবাজার এবং শান্তিপুরের মানুষের ঘরবাড়ি, গাছগাছালি ও হাওরের ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেংরাটিলা গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক (গণিত) মো. ফয়েজুর রহমান বলেন, আগে পাইপ দিয়ে গ্রামের অনেকে গ্যাস ব্যবহার করেছে। এখন সেভাবে ব্যবহার না করা গেলেও গ্যাস উদগীরণ অব্যাহত আছে। আশপাশের কিছু এলাকায় এখন গাছপালা জন্মায় না। মাটির উর্বরতা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। টেংরাটিলা, আজবপুর যার প্রভাব একটু বেশি। তিনি বলেন, বিষ্ফোরণের পর অনেকে শ্বাসকষ্ট এবং চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার প্রভাব এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। টেংরাটিলা গ্রামের আবুল কাশেম ও আবুল হোসেন বলেন, আগের মতো গ্যাস বের হচ্ছে না। কিন্তু বিষ্ফোরণের প্রভাবে মাটি নষ্ট হয়ে গেছে। মাটির গভীরে যায় এমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু সহ গাছ এখানে বাঁচে না। মাটির উপরের অংশে এবং কম গভীরতায় থাকা ঘাস ও শাক সবজি হয় শুধু। টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডের আশেপাশের এলাকার পানি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে উল্লেখ করে তারা বলেন, পানীয় জলের সমস্যা আমাদের জন্য একেবারে স্থায়ী হয়ে গেছে। আর্সেনিক আর আয়রনে পানি ভরপুর। গ্রাম থেকে আধা কিলোমিটার দূর থেকে আমাদের পানি সংগ্রহ করতে হয়। অদূর ভবিষ্যতে মনে হয় না আমরা গ্যাসফিল্ডের আশেপাশের পানি ব্যবহার করতে পারবো। জলাশয় খালবিল, টিউবয়েলের পানি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আর্সেনিকের প্রভাবে অনেকের হাত ফোস্কায় ভরে গেছে। তারা আরও বলেন, আগে গ্যাস ফিল্ডের নিরাপত্তায় কন্ট্রোল রুম ছিল। কিন্তু এখন আর এখানে কোন কার্যক্রম নেই। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি উঠেছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি কেউই পায়নি। দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাস্টার বলেন, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে বিস্ফোরণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। প্রশাসনের কাছে আমি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।এসময় তিনি টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩ মে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, কানাডার কো¤পানি নাইকোর অদক্ষতার কারণে ২০০৫ সালে দুইবার টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটে। টেংরাটিলা বিস্ফোরণের জন্য নাইকো দায়ী এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আট হাজার কোটি টাকা পেতে পারে বাংলাদেশ। ব্রিটেনের লন্ডনে বিনিয়োগ বিরোধ নি®পত্তিসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত (ইকসিড) এমন রায় দিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে নসরুল হামিদ বলেন, ২০০৩ সালে নাইকো-বাপেক্স যৌথ উদ্যোগে একটি চুক্তির মাধ্যমে ছাতকের টেংরাটিলায় গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কূপ খনন শুরু হলে গ্যাসক্ষেত্রটিতে মারাত্মক বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের ফলে গ্যাসক্ষেত্র এবং তার আশপাশের এলাকায় পরিবেশ ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি করে। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে ওই বছরের ২৪ জুন।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ