আক্তাপাড়ায় দুই যুগ ধরে বাহারি নৌকা নিয়ে আসেন আলঙ্গীরা


জামিউল ইসলাম তুরান, শান্তিগঞ্জ::
এগারো হাজার টেখা দিমু। পারলে দিলাও বা মাজন সাব। বাক্কা দূর থাকি আইছি। টেখাও কম লইয়া আইছি। নাওখান আমার ভালা লাগছে, প্রত্যেক বছরই এখান না এখান নাও আমি নেই। মায়া পাইলে আপনার কাছ থাকি আরো নাও নিমুনে। এগারো হাজারে দিলাওকা। এ দামে ১৬ হাতের তাড় তেল দেওয়া নৌকাটি বিক্রি করতে রাজি নন আলঙ্গী অপি আলম রাজু। রাজু শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের রনসী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরেই নৌকা তৈরি ও বিক্রির কাজ করেন। তিনি নৌকাটির দাম চাইলেন ১৪ হাজার টাকা। দুই দাম নিয়ে দিরাইয়ের মকছদপুর থেকে আসা ক্রেতা মজম্মিল হোসেন আর আলঙ্গী অপি আলম রাজুর মাঝে দরকষাকষি চলছিলো। মাঝখানে বাজার ইজারাদার শামসুদ্দিন সুনুসহ আরো বেশ ক’জনের সহযোগিতায় নৌকার চূড়ান্ত দাম নির্ধারণ হয় ১২ হাজার টাকা। এই দরদামের ফাঁকে আরো ৩টি ছোট নৌকা বিক্রি হয়েছে। বিক্রিত নৌকার রশিদ কাটছেন একজন। স্থানীয় ভাষায় রশিদকে সীট বলা হয়। সীটে লেখা থাকে কোন ধরণের নৌকা, কোন কাঠের, নতুন নাকি পুরাতন, কেমন গলুই, নৌকায় কয়টা গোড়া ইত্যাদি। শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আক্তাপাড়া মিনাবাজারে প্রায় ২ যুগ ধরে এভাবেই বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ধরণের নৌকা। উপজেলার একমাত্র নৌকার বাজার হিসেবে প্রতি শুক্রবারে আক্তাপাড়ায় বসে নৌকার হাট। শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, দিরাই, জগন্নাথপুর, ছাতক এমনকি কখনো কখনো হবিগঞ্জ, আজমিরিগঞ্জ থেকেও বজরা আসে এ বাজারে। প্রতি বাজারে গড়ে শ খানেক বিভিন্ন ধরণের নৌকা বিক্রি হয় হাটে। আমতলী, হিল্লা, পাতামী ও বারকী। সাধারণত এই চারধরণের নৌকা আক্তাপাড়া বাজারে উঠে। এসব নৌকা তৈরিতে চাম্বল, আম আর রেইন্ট্রি কাঠ বেশি ব্যবহার করা হয়। নৌকায় গোড়া দেওয়া হয় ৭ থেকে ৯টি। নতুন নৌকার পাশাপাশি পুরনো নৌকাও প্রায়শ বিক্রি হয় এ হাটে। ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এসব নৌকা। ভিন্ন ঢঙের গলুয়ের উপর নির্ভর দাম উঠানামা করে। আক্তাপাড়া মিনাবাজারে শুধু যে আমতলী, হিল্লা, পাতামী আর বারকী নৌকাই বিক্রি হয় তা কিন্তু নয়, বর্ষায় যখন মহাসিং আর সবক’টা হাওর জলগর্ভা থাকে তখন যাত্রী টানার নৌকা, বড় বড় বজরা আসে এ বাজারে। বর্ষা ছাড়া খুব একটা নৌকার হাট থাকে না। বর্ষায় কিংবা বর্ষা শুরুর আগে নৌকার বাজার খুব গরম থাকে। তখন চতুর্দিক থেকেই নৌকা আসে এ বাজারটিতে। সাধারণত পূর্ব পাগলা, পশ্চিম পাগলা, চেচান, সিংচাপই, নোয়াগাঁও, বাউনুগলি, ছাতক সদর, আসামপুর, জিয়াপুর থেকে আলঙ্গীরা নতুন-পুরাতন নৌকা নিয়ে আসেন বাজারটিতে। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে শ খানেক নৌকা বিক্রি করা যায়। নৌকার এ বাজারকে কেন্দ্র করে আলাদা করে ৫/৭শ মানুষ বেশি আসেন আক্তাপাড়ায়। সপ্তাহের বিশেষ এ দিনে (শুক্রবার) অন্যান্য দিনের তুলনায় বিক্রি বাড়ে বাজারে থাকা অন্য ব্যবসায়ীদেরও। নৌকার বাজার এখন এ এলাকার ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় ফেরদৌস আহমদ নামের একজন বলেন, আক্তাপাড়া মিনাবাজার আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। নৌকা আর বাঁশ বাজারের জন্য অনেকটা বিখ্যাত আমাদের বাজার। এ বাজার থেকে সরকার যথেষ্ট মুনাফাও পাচ্ছেন। বাজারের আরো রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। নৌকা বাজারের ইজারাদার শামসুদ্দিন সুনু বলেন, নৌকা বাজার আর বাঁশ বাজার পৃথক। দু’টি বাজারই নিজস্ব ঐতিহ্য বহণ করে চলে। আমরা চাই বাজারটির আরো উন্নয়ন করা হোক। কারণ এখান থেকে সরকার ভালো পরিমানের একটা রাজস্ব পাচ্ছেন। আলঙ্গী কারা? আলঙ্গী বিশেষ একটি শব্দ। স্থানীয় ভাষার শব্দ এটি। ঠিক কবে থেকে, কে ব্যবহার শুরু করেছেন শব্দটির তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় নি। যারা কারিগর দিয়ে নৌকা তৈরি করে বাজারে এনে নিজে বিক্রি করেন তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় আলঙ্গী বলে। কোনো কোনো নৌকার কারিগর নিজে নৌকা তৈরি করেন আবার নিজেই বিক্রি করেন। আক্তাপাড়া মিনা বাজারের বড় আলঙ্গী বলতে অপি আলম রাজুকেই বুঝায়। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, সীজনের সময় প্রতি বাজারে কমপক্ষে ১৫টি নৌকা আমি বিক্রি করতে পারি। বিভিন্ন জায়গা থেকে কারিগর এনে নৌকা তৈরি করাই। তারপর সে নৌকাগুলোই আমি নিজে বাজারে নিয়ে আসি। আক্তাপাড়া ছাড়াও আরো বিভিন্ন বাজারে নৌকা নিয়ে
যাই। আক্তাপাড়ায় আসার পথ::-নদী ও সড়ক উভয় পথেই আক্তাপাড়া বাজারে আসা যায়। সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের
শান্তিগঞ্জের পাগলা বাজার সংলগ্ন ডাবর পয়েন্ট থেকে পাগলা-জগন্নাথপুর সড়কে করে গেলেই ৫কিলোমিটার পর আক্তাপাড়া মিনাবাজার। নদী পথে সুরমার শাখা নদী মহাসিং-এর পথ ধরে ডাবর ব্রিজের নিচ দিয়ে সোজা দক্ষিণপূর্বে নূরপুর, ধরাধরপুর গ্রাম পেরিয়েই আক্তাপাড়া। জগন্নাথপু থেকেও আক্তাপাড়া আসার রাস্তা হচ্ছে জগন্নাথপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক। জিয়াপুর থেকে নদী পথেও আক্তাপাড়ায় আসা যায়। বৈঠার পৃথক হাট নৌকা বাজারকে কেন্দ্র করে একই দিনে বৈঠার একটি স্বতন্ত্র হাটই যেনো বসে নৌকা বাজারের পাশে। হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ থেকে এ বাজারসহ আশপাশের বাজারগুলোতে ১৫/২০ বছর ধরে শুধু বৈঠার ব্যবসা করে থাকেন আশরাফুল ইসলাম। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি জানান, যেদিন যে বাজারে যাই গড়ে ৬০/৮০টি বৈঠা বিক্রি করতে পারি। প্রতিটি বৈঠা ১শ ৪০ টাকা থেকে ৪শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। সাধারণত আম, চাম্বল জাতীয় কাঠই বৈঠা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। পাগলা বাজার, সাচনা বাচার, সুনামগঞ্জ শহরসহ নানান জায়গায় প্রায় ২০ বছর ধরে বৈঠা বিক্রি করে আসছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, বাজারের কোনো সমস্যা থাকলে বাজারের দায়ীত্বে যারা আছেন তারা আমাকে জানাতে হবে। জানালে আমি বিষয়টি দেখবো।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ